সারাদেশে খাদ্যগুদামগুলোতে শস্য লোড-আনলোড কার্যক্রমের জন্য দুই বছর মেয়াদে ঠিকাদার নিয়োগ দেয় খাদ্য বিভাগ। কিন্তু তাদের সেই দুই বছরের মেয়াদ ১৮-২০ বছরেও শেষ হয় না। মেয়াদ শেষে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে গেলেই মামলা করেন পুরোনো ঠিকাদাররা। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে কাজ চালিয়ে যান বছরের পর বছর। দেশের ৬৫০টি গুদামের মধ্যে ৪৪৮ বা প্রায় ৬৯ শতাংশ গুদামেই চলছে এমন ঘটনা। ফলে সারাদেশে হাতেগোনা কয়েকজন ঠিকাদারের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা, কৃষক ও মিল মালিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারদের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খাদ্য বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কোর্টের জিপিরা। ফলে ঠুনকো অজুহাতে মামলাগুলো চলছে বছরের পর বছর। মামলা নিষ্পত্তি না করার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে তারা পাচ্ছেন আর্থিক সুবিধা।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকাল সাপ্লাই ডিপো (এলএসডি) রয়েছে ৬৩০টি, সেন্ট্রাল সাপ্লাই ডিপো (সিএসডি) ১৩টি, সাইলো ৫টি, ময়দা মিল ১টি এবং ওয়্যারহাউস একটি। এর মধ্যে ৪৪৮টি বা ৬৮ দশমিক ৯২ ভাগ খাদ্যগুদামে মামলা চলমান থাকায় নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করতে পারছে না খাদ্য অধিদপ্তর।
কিশোরগঞ্জ জেলার টেন্ডারের নোটিশ না পাওয়ার অভিযোগে মাদারীপুর জেলা আদালতে মামলা করেছেন ঠিকাদার মেসার্স মোল্যা অ্যান্ড কোং-এর মালিক চুন্নু মিয়া। এরপর ঠিকাদার নিয়োগের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ জেলার ১৪টি খাদ্যগুদামে সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করেন আদালত। অথচ চুন্নু মিয়া কিশোরগঞ্জে কখনও কাজই করেননি। অভিযোগ রয়েছে, চুন্নু মিয়াকে দিয়ে মামলা করিয়ে ভৈরব উপজেলাসহ কয়েকটি উপজেলায় এককভাবে কাজ করে আসছেন কিশোরগঞ্জের ঠিকাদার সাদরুল্লাহ। একইভাবে সাতক্ষীরা জেলায় মাস্টাররোলে শ্রমিক নিয়োগের বিরুদ্ধে মামলা করেন ঠিকাদার সেলিম রেজা।
এরপর সাতক্ষীরার ৯টি খাদ্যগুদামে ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। একই কৌশলে ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে কুষ্টিয়া জেলায় ৭টি গুদাম। এভাবে সারাদেশে প্রায় ১০০ মামলার কারণে ৪৪৮টি খাদ্যগুদামে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ বন্ধ আছে। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না হওয়ায় শ্রমিকদের মজুরিও বাড়ানো হয়নি।
জানতে চাইলে ঠিকাদার চুন্নু মিয়া বলেন, ‘সাদরুল্লাহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে তার কথায় মামলা করিনি। সাত থেকে আট বছর আগে আমি নিজেই মাদারীপুর আদালতে মামলাটি করেছিলাম।’
কিশোরগঞ্জের পরিবহন ঠিকাদার মো. মহিউদ্দিন বলেন, মামলা চলায় কিশোরগঞ্জের গুদামগুলোতে পুরোনো ঠিকাদাররাই কাজ করছেন ১৮-২০ বছর ধরে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অনেক, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। ফলে তারা কৃষক ও মিল মালিকদের কাছে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। এ জন্য কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান দিতে চান না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, পুরোনো ঠিকাদাররা একাই সব কাজ করতে চায়। ফলে এ জটিলতা তৈরি হয়েছে। এখন মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি দ্রুত এ সমস্যা সমাধান হবে।
মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না : দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ঠিকাদাররা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে না।
বাংলাদেশ খাদ্য শ্রমিক হস্তার্পণ ঠিকাদার সমিতির সভাপতি সেলিম রেজা বলেন, খাদ্য কর্মকর্তারা চাকরির পাশাপাশি ঠিকাদারি করতে চান। এ জন্য মাস্টাররোলে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছেন। এ জন্য আদালতে মামলা করেছি। এ ছাড়া তাদের টেন্ডার নোটিশে অনেক ভুল থাকে। অভিজ্ঞতা চান, তাই অনেক ঠিকাদার মামলা করেন।
পুরোনো ঠিকাদাররা কাজ না ছাড়ার জন্য আদালতে মামলা করার অভিযোগের বিষয়ে বলেন, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন।
সাতক্ষীরা জেলার ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক প্রিয় কমল চাকমা বলেন, ঠিকাদাররা তাদের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বেশিরভাগ গুদামে মামলা করায় সরকার মাস্টাররোলে শ্রমিক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মামলা করেছেন ঠিকাদাররা।
তিনি বলেন, একটি মামলার ফলে পুরো জেলার টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছে। এরপরও তারা মামলা উত্তোলন করছেন না। এখন আগের ঠিকাদারদের মেয়াদ বৃদ্ধি করে কাজ চালানো হচ্ছে।
করোনার অজুহাতেও মামলা : করোনা মহামারিতে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি হওয়ার অজুহাতে পরিবহন শ্রমিকরাও মামলা করেছে বিভিন্ন জেলায়। তাদের দাবি, করোনাকালের দুই বছর তাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। তাদের ক্ষতি পূরণে নতুন টেন্ডার না দিয়ে আগের ঠিকারদারদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইদুর রহমান বলেন, করোনাকালে তাদের ২০ হাজার টাকার গাড়ি ভাড়া ২৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। খাদ্যশস্য পৌঁছানো জরুরি হওয়ায় তাদের প্রতিনিধিরা বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে কাজ করেছে। করোনাকাল শেষেই নতুন ঠিকাদার নিয়োগের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। তাই হাইকোর্টে তারা মামলা করেছেন।
ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না শ্রমিকরা : মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। ট্রাক হতে ১ টন চাল লোড-আনলোডের জন্য তাদের মজুরি ৩৫ টাকা, নৌকা হতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, রেল হতে ৩৫ টাকা, নৌযান থেকে নৌযানে ৩২ টাকা, নৌযান থেকে সড়কযানে ৫৭ টাকা, সড়ক-সড়ক, সড়ক-রেল, রেল-রেলযানে ১০ টাকা। ভৈরব খাদ্য গুদামের শ্রমিকদের সর্দার সালাম মিয়া বলেন, তারা নৌকা হতে খাদ্যশস্য লোড-আনলোড করেন। এতে প্রতি টন চালের জন্য ঠিকাদাররা তাদের ১০০ টাকা মজুরি দেন। সারাদিনে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০টির অধিক এলএসডির সর্দার বলেন, ঠিকাদারদের মাধ্যমে সরকার যে মজুরি দেয় এতে তাদের চলে না। ফলে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তারা মিলার ও কৃষকদের কাছ থেকে তাদের কমিশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
জানা যায়, প্রতি টন চালের জন্য একজন মিলারকে ১২০ টাকা দিতে হয়। আর কৃষকদের প্রতি টন ধানের জন্য ২৫০ টাকা দিতে হয়। যদিও আইনে ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিল পরিশোধের বিধান রয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, এসব ঝামেলার কারণে তারা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করেন না। কম দরে বাজারে বিক্রি করেন।
চালকল মালিক সি মজুমদার বলেন, খাদ্যগুদামগুলোতে যুগ যুগ ধরে অনিয়ম চলছে। ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কাছে সবাই জিম্মি। এটার নিরসন হওয়া প্রয়োজন।